Friday, April 19, 2024

হারিয়ে যাওয়া এক উৎসব গাস্বী

নেহাল আহমেদ: মানুষ অনেকটা বদলে গেছে।অভ্যস্ত হয়ে গেছে যান্ত্রিক জীবনে। পাড়ায়, মহল্লায় লাইব্রেরিসহ ক্লাবগুলোর কর্মকান্ড হয়ে গেছে সীমিত। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সামাজিক সংগঠন। কেউ আর কষ্ট করে গ্রামে-গঞ্জে পালাগান কিংব গানের আসরের আয়োজন করে না। গ্রামীণ শিল্পীরা বন্ধ করে দিয়েছে তাদের চিরায়ত সঙ্গীতচর্চা। নদীতে আর পালতোলা নৌকা দেখা যায় না। থেমে গেছে মাঝির ভাটিয়ালি গান। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ছেড়ে মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠছে ঘরমুখো।গ্রামীন ঐতিহ্য, পালাগান জারিগান কবির লড়াই,নৌকা বাইচ,যাত্রা পালা সার্কাস এখন আর তেমন চোখে পড়ে না

তবু গ্রামে রয়েগেছে কিছু গ্রামীন ঐতিহ্য শহরের ছেলে মেয়েরা এসবের সাথে পরিচিত নয়।এমননি একটা উৎসব হার্ছি বা গাস্বী। হার্ছি মুলত কৃষি উৎসব। আশ্বিন সংক্রান্তিতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় এ উৎসব হয়ে থাকে।সারা রাত ভরে জাগ দিয়ে পরের দিন খাওয়া হয়।

আশ্বিনে রাধে কার্তিকে খায়,

যে বর মাগে সে বর পায়।

এ রাতে ভুত তাড়ানোর জন্য আগুন জ্বালানো,হাডুডু খেলা সহ বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়।
কবি জসীমউদ্দিন গাস্বী সম্পর্কে তার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা বর্নণা করে বলেছেন-”আমরা ছেলেবেলায় সারা বৎসর এই গাস্বীর দিনটির প্রতি তাকিয়া থাকিতাম। সারাদিন এ বন ও বন ঘুরিয়া তেলাকুচের পাতা,আমগুরুজের লতা, হলদী, পানের গাছ, মেথি, বড় কচুর পাতা প্রভৃতি সংগ্রহ করিতাম। তাহার পর উঠানের এক জায়গা ভালমত লেপিয়া সারাদিনের কুড়ান সামগ্রীসহ তালের আটি ও নারিকেল, পান সুপারি, সুন্দা মেথি, কাজল তুলিবার জন্য কলার ডাটা প্রভৃতি একটি বড় কচুর পাতার উপর আর একটি কচু পাতা দিয়ে ঢাকিয়া রাখিতাম। শেষ রাত্রি উঠিয়া আগুন জ্বালাইয়া আগুনের চারিদিকে ঘুরিয়া মশা তাড়ানোর মন্ত্র পরিতাম……

যা যা মশা মাছি উইড়া যা

আমাগো বাড়িত্যে অমুকের বাড়ি যা।

গাস্বী রাত্রে যে গাছে ফল ধরে না একটা কুড়াল লইয়া দু একটা কোপ দিতাম আর বলিতাম “এই গাছে ফল ধরে না এই গাছ আজ কাটিয়াই ফেলিব।’ আর একজন যাইয়া বলিত ‘না না কাটিস না। এ বছর ধরিবে।’ তখন নিরস্ত হইতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল ঐরুপ করিলে গাছে ফল ধরিবে। গাস্বীর রাত্রে যাহারা মন্ত্র তন্ত্র জানতো তাহারা সারারাত জাগিয়া সেই মন্ত্র তন্ত্র আওড়াইতো। তাহাদের বিশ্বাস ছিল এরুপ করিলে সেই তন্ত্র মন্ত্র ফলদায়ক হইবে। অনেকের বাড়িতে সারারাত গান হইত। আস্তে আস্তে ভোরের আকাশ রঙ্গিন করিয়া সূর্য উঠিত। আমরা তখন সেই সুন্দ্রা মেথি, আম-গুরুজের লতা, তেলাকুচের পাতা ও হলদী পাটায় বাটিয়া সারা গায়ে মাখিয়া নদীতে স্নান করিতে যাইতাম। ফিরিয়া আসিতে কলার ডাঁটার কাজল করিয়া মা আমাদের চোখে পরাইয়া দিতেন। তারপর তালের শাঁস, নারিকেল, গুড় আর চিড়ামুড়িসহ অপুর্ব নাস্তা করিয়া পাড়ায় বেড়াইতে যাইতাম। নইমদ্দি মোল্লার বাড়িতে হালটে কুস্তি ও হাডুডু খেলা হইত। নদীর ওপর চরে লাঠিখেলা হইত। তাহা দেখিয়া দুপুরে বারি ফিরিতাম। বাড়িতে সেদিন ভাল খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হইত। গাস্বীর পরদিন বড়রা বিলে ঝিলে পলো লইয়া মাছ ধরিতে যাইত। গাছিরা অন্তত একটি খেজুর গাছর ডগা কাটিয়া ভবিষ্যতে রস বাহির করার ব্যবস্থা করিত। “হলুদ গাছের ফুল দিয়ে আচমকা বাড়ি দিলে সইদ সেরে যাবে বলে বিশ্বাস করা হতো।

আশ্বিন সংক্রান্তির সকালে নদীর বা পুকুর ঘাট থেকে কাঁদা মাটি এনে প্রয়োজনমতো প্রদীপ বানানো হয় এবং তা রোদে শুকানো হয়। সন্ধের মধ্যে গাস্বীর প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করে মধ্য উঠোনে রাখা হয়। কাঁচা হলুদ, হলুদের ফুল, কুমড়ো,একটি জল ভর্তি ঘট, কলাপাতা সহ বিভিন্ন গাছের পাতা
ইত্যাদি।

জলভর্তি ঘটে সর্ষে তেল দেওয়া হয়। সমস্ত কিছু উঠানে জাগাতে হয়। ভোরবেলা ঘরের যেখানে গৃহদেবতার আসন পাতা থাকে সেখানে বড় মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং পরিবারের সকল সদস্য সেই প্রদীপের শিখার তাপ এবং প্রদীপের তেল মাখিয়ে প্রণাম করে । তারপর বাড়ির উঠোনে, তুলসীতলা, গোয়ালঘর ,ফলের গাছের গোড়ায় ,ঘরের সামনে একটি করে প্রদীপ জ্বালায় । পরিবারের কোনো এক সদস্য ফলের গাছ গুলোতে খড়ের দঁড়ি বেঁধে দেয় এবং দাঁ দিয়ে এক কোপে একটু ছাল তুলে দেয়। বাড়ির মহিলারা রাত জাগানো ওষধি গাছের পাতা , কাঁচা হলুদ ,সর্ষে বেটে রাখে। সেই বাটা গায়ে মাখিয়ে সকালবেলা স্নান করে এবং ঘটের জল দেওয়া যে সরষের তেল দেওয়া ছিল তা সারা গায়ে মাখায়।সেদিন কেউ সাবান বা গায়ে মাখার অন্যান্য দ্রব্য ব্যবহার করেন না ।

ঘটের মধ্যে তেল চাকার মত আকার ধারণ করে । সেগুলো দেখে অনুমিত হয় সারা বছর আর্থিক অবস্থা কেমন যাবে । ভোরবেলা গাছ কাটার দাঁ দিয়ে কুমড়ো বলি দেওয়া হয় । পাটকাঠি দিয়ে ঘরদোর সর্প দোষ কাটানো হয় আর ছড়া কাটেন—। “সাপিলো কুপি লো,ঘর থেকে বাইরে যা” বিশ্বাস গাস্বীর রাতে এই নিয়ম করলে ঘরের মধ্যে সাপ,পোঁকা-মাকড় ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । বৈশ্য কাপালী সমাজে এই রূপ রীতি পালন করা হয় । লোকবিশ্বাস এইসব নিয়ম করলে চর্মরোগ সহ অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং সংসারের বিপদ আপদ দূর হয়।আশ্বিন সংক্রান্তির সকালে নদীর বা পুকুর ঘাট থেকে কাঁদা মাটি এনে প্রয়োজনমতো প্রদীপ বানানো হয় এবং তা রোদে শুকানো হয়। সন্ধের মধ্যে গাস্বীর প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করে মধ্য উঠোনে রাখা হয়। কাঁচা হলুদ, হলুদের ফুল, কুমড়ো,একটি জল ভর্তি ঘট, কলাপাতা সহ বিভিন্ন গাছের পাতা
ইত্যাদি।

জলভর্তি ঘটে সর্ষে তেল দেওয়া হয়। সমস্ত কিছু উঠানে জাগাতে হয়। ভোরবেলা ঘরের যেখানে গৃহদেবতার আসন পাতা থাকে সেখানে বড় মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং পরিবারের সকল সদস্য সেই প্রদীপের শিখার তাপ এবং প্রদীপের তেল মাখিয়ে প্রণাম করে ।

 

সূত্র বাংলার লোক সাংস্কৃতি -ওয়াকিল আহমেদ
নেহাল আহমেদ-
কবি ও সাংবাদিক

সর্বশেষ পোষ্ট

এই ধরনের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here