পদ্মর সর্বগ্রাসী থাবা কেড়ে নিয়েছে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি সুলতান কে সেই সাথে পদ্মার বুকে সমাধি হয়েছে একটি পরিবারের বেচে থাকার অবলম্বন। নোনা জ্বলে আকাশ বাতাস ভারী হয়েছে এক বৃদ্ধা মায়ের। বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল হারিয়ে পাগল প্রায় পরিবার।
ঘটনাটি ঘটেছে গত বুধবার (১৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় সময় নদীর পারে লুঙ্গি, গামছা, নিজের ব্যাবহৃত মোবাইল ফোন আর সামান্য কিছু টাকা নদীর পারে রেখে প্রবল স্রোতময় পদ্মায় গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হয় সুলতান শিকদার। নিখোঁজের ৬দিন (মঙ্গলবার, ২৫আগস্ট) পার হলেও আজও সুলতানকে খুঁজে পাওয়া জায়নি।
গত বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) ভোর থেকে যৌথভাবে কয়েক দফা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেন রাজবাড়ী ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, গোয়ালন্দ ফায়ার সার্ভিস স্টেশন এবং পাটুরিয়া ফায়ার সার্ভিস স্শেনের একটি ডুবুরী দল।
কিন্তু নদীতে প্রচন্ড স্রোতের কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হওয়ায় ঐ দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজবাড়ী ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, এ উদ্ধার কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।পরে স্বজনেরা পদ্মার নদীর বিভিন্ন অঞ্চলে মাইকিং করেও তার সন্ধান পায়নি।
বাবা অন্যত্র বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন প্রায় ৩০বছর আগে। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালালেও মাত্র ৭বছর বয়সে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট এলাকায় কুলির কাজ করে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে শিশু সুলতানকে।
সেই থেকে সংগ্রামী জীবনের শুরু এরি মধ্যে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। মা, ২মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ৫ জনের ছোট সংসার সুলতানের।
নিজস্ব কোন জায়গা জমি না থাকায় দৌলতদিয়া ২নং ও ৩নং ফেরিঘাটের মাঝামাঝি ছিদ্দিক কাজীর পাড়া এলাকায় অন্যের জমিতে ভাঙা চোরা একটি ঝুঁপড়ি ঘর করে সবাইকে নিয়ে বসবাস করেন। অভাবের তাড়নায় প্রতিদিন কাজ করতে হয় তার। কাজ না করলে খাবার জোটে না। আর তাইতো ঘাটে সিমেন্ট বোঝাই কার্গো জাহাজে কুলির কাজ করে পরিবারের সদস্যদের আহারের ব্যবস্থা করতো। সেই কাজ করে ভালই চলছিল তাদের জীবন কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সেই সুখ ও তার কপালে সইলো না।
নিত্য দিনের মত ১৮আগস্ট সে জাহাজ থেকে সারাদিন সিমেন্ট ঘাটে নামান। সন্ধ্যার একটু আগে কাজ শেষ করে ২নং ফেরিঘাটের মাথায় নদী পারে লুঙ্গি, মোবাইল ও ৯৮০ টাকা রেখে গোসল করতে নামেন প্রবাহমান পদ্মায়। কিন্তু সেই যে পদ্মায় নেমেছেন আজ ৮দিন হয়ে গেলেও উদ্ধার করা যায়নি তাকে, মাইকিং করেও খোঁজ মেলেনি পদ্মা নদীর কোথাও।প্রতিবেশীরা বলেন ভরা সন্ধ্যায় সুলতান নদীতে নেমে ছিল হয়তো স্রোতের কোন জিও ব্যাগের নিচে আটকে পরেছে বা নদীর স্রোত তাকে অনেক দুর টেনে নিয়ে গেছে। খুজতে গেলে ট্রলার ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু পরিবারের নিকট সেই টাকা না থাকায় উদ্ধার কাজ আর বেশিদুর এগোয়নি।
ছোট ছোট দুটো মেয়ে উদাস চোখে চেয়ে আছে। প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতার সাথে তাদের পরিচয় নেই। ছোট মেয়েটির বোঝার বয়স হয়নি যে তার বাবা নেই। সুলতানের মা আন্না বেগম(৫০) স্ত্রী সেলিনার বয়স ৩৪ বা ৩৫ হবে। আর্তনাত করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। দুই মেয়ে আর বৃদ্ধ শাশুড়ী নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে পদ্মার ভয়াল স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আজ বৃহস্পতিবার (২৬আগস্ট) সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে নিখোঁজ স্বামীর জন্য কাঁদতেও পাড়ছেন না সুলতান শিকদারের স্ত্রী অসহায় সেলিনা আক্তার (৩৪)।একই অবস্থা বৃদ্ধা মা আনোয়ারা বেগমেরও (৫৪) ছেলের শোকে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন তিনি। অবুজ শিশু শান্তি (১১) ও রাবেয়া (৫) ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নদীর পানে কখন তাদের বাবা ঘরে ফিরে আসে সেই আসায়।
নিহত সুলতানের স্ত্রী সেলিনা আক্তার কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, উনিই ছিল আমাদের সব। তার আয়েই চলত আমাদের সংসার। কিন্তু আজ ৮দিন হয়ে গেল আমাদের ছেড়ে চলে গেল সে, এখন আমাদের কি হবে। দুই মেয়ে ও শাশুড়ীকে নিয়ে আমি কোথায় যাব, কিভাবে চলবো, কি খাওয়াবো তাদের, আমাদের তো বাঁচার মত কোন অবলম্বনই রইলো না।
ছেলে হারানোর শোকে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম, কথা বলার শক্তিও হাড়িয়ে ফেলেছেন তিনি, এ অবস্থায় তিনি বলেন, আমাদের কেউ নেই বাবা , আমাদের এখন কি হবে, আমরা কিভাবে বাঁচবো। আমার ছেলেরে তোরা আইনা দে এই কথা বলতে বলতে তিনি কাঁদতে থাকেন।
স্থানীয়রা জানায়, সুলতানের পরিবারটি নিতান্তই গরিব। দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতো। বাড়িতে উপার্জনক্ষম কেউ নেই। চারজন নারী এক প্রকার নিঃস্ব হয়ে গেল বলা যায়। এর মধ্যে কেউ তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি স্থানীয় চেয়ারম্যান খোজ নেয়নি। শুধু মাত্র দৌলতদিয়া ২ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আশরাফ হোসেন তাদেরকে পাচ হাজার টাকা সহায়তা করেছেন। এই অবস্থায় সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুল হক খান মামুন বলেন, সুলতান নিখোঁজে দ্বিতীয় দিন আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তার পরিবারের খোঁজ খবর নেই। উর্দ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে পরিবারটির জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ব্যবস্থা করা হবে।