আজ মহান একুশে, আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস
– ঃ রোমানা কবির ঃ –
আজ সোমবার একুশে ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালে এই দিবসে সংঘটিত বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ( বর্তমান বাংলাদেশ) একটি সাংকৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে গণ দাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে এ আনদোলন চুড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয়েছিল অনেক আগে। অন্য দিকে এর প্রতিক্রীয়া ও ফলাফল ছিলো সুদুরপ্রসারি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্ত্বিতে বৃটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দু’টি অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিলো। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষনা করে যে, উর্দ্ধুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রোভাষা। এ ঘোষনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারন জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ফরস্বরূপ বাংলাভাষাকে সম – সর্যাদার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেধে ওঠে।
আনদোলন দমাতে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমস্ত প্রকার সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি আন্দোলন বে-আইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী মোতাবেক ( ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনরতদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হয় রফিক – শফিক -সালাম জব্বার – বরকত সহ নাম না জানা আরও অনেকে। শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমোবর্ধমাণ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষাবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০০০ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্সিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।
ভাষা শহীদদের স্মরনে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত “মোদের গরব” ভাস্কর্য। ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারী মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যূষে সর্বস্তরের মানুষ নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুস্পার্গ অর্পণ করেন। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে থাকে। এছাড়াও এই দিনটিকে ঘিরে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আনদোলনের স্মৃতি তর্পণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হিসাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিনটি কখনো জাতীয় শোক দিবস, কখনোবা জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রিয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে উদযাপিত হচ্ছে।
বর্তমানের পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পূর্বে বৃটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অনতর্ভূক্ত ছিল। উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দূ ভাষাটিকে কিছু সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতা খাজা স্যার সলিমুল্লাহ্, স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান নবাব ওয়াকার – উল – মুলক মৌলভী, এবং মৌলভী আব্দুল হক প্রমূখদের চেষ্টায় ভরতীয় মুসলমানদের “লিঙ্গুয়া ফ্রাস্কায়” উন্নিত হয়। উর্দূ একটি ইন্দো আর্য ভাষা, যা ইন্দো – ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। এ ভাষাটি আবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। উর্দূ ভাষাটি অপভ্রংশের (মধ্যযুগের ইন্দো আর্য ভাষা পালি প্রাকৃতের সর্বশেষ ভাষা তাত্ত্বিক অবস্থা) ওপর ফার্সি, আরবি এবং তুর্কির ঘনিষ্ঠ প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে দিল্লি সুলতানাত ও মুঘল সম্রাজ্যের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত হয়। এর পারসিক আরবি লিপির কারণে উর্দূকে ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামি সাংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। যেখানে হিন্দি ও দেবনাগরী লিপিকি হিন্দুধর্মের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
১৯৫২ সালে পুরাতন কলাভবন উর্দূর ব্যবহারকে ক্রমাগতই ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। কিন্তু বাংলার মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিলো। বাংলা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য ইন্দো ভাষা সমুহ থেকে উদ্ভুত একটি পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো আর্য ভাষা, যা বাংলার নবজাগরনের সময় বিপুল বিকাশ লাভ করে। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার বিস্তার তখন থেকেই বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার সমর্থকেরা ভারত ভাগের আগেই উর্দূকে বিরোধিতা করে আসছিল। যখন ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দূকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাস্কা মনোনয়নের প্রস্তাবকে প্রত্যাখান করেন। মুসলিম লীগ ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি রাজনৈতিক দল, যা ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্রো হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রনী ভূমীকা পালন করে।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশশাসিত অঞ্চলগুলো ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে চারটি ভৌগলিক রাষ্ট্র পরানত হয়, ভারত, বার্মা (বর্তমান মায়ানমার), সিংহল (বর্তমান শীলঙ্কা),এবং পাকিস্তান।
লেখক: রোমানা কবির
সহ – সভাপতি
বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগ
বালিয়াকান্দি উপজেলা শাখা
রাজবাড়ী।