ডেস্কঃ তিনি কি আসলেই বাংলার বাঘ ছিলেন!!!! নাকি কই মাছ আর মুরগী খাওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন?????? আসুন দেখি…….
১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক বরিশালের রাজাপুরে জন্মগ্রহন করেন।
ফজলুল হকের বাবা কাজী মুহাম্মদ ওয়াজেদ বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ষষ্ঠ গ্রাজুয়েট ছিলেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন।
এ কে ফজলুল হক ১৮৮৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় (বর্তমানে এস এস সি) তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন এবং ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ এ (এইচ এস সি) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৩ সালে গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্স সহ প্রথম শ্রেনীতে বি এ পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রথমে ইংরেজী সাহিত্যে মাস্টার্স করার জন্য ভর্তি হলেও ছয় মাস পর এক বন্ধুর কটুক্তিতে(মুসলমানরা গণিত নিয়ে পড়ে না, তারা মেধাবী না) ইংরেজী সাহিত্য বাদ দিয়ে গণিত নিয়ে পড়া শুরু করেন এবং ছয় মাসের প্রস্তুতি দিয়েই গণিতে প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হন।
১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএল পাস করে স্যার আশুতোষ মূখার্জির শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যাবসা শুরু করেন।
১৯০০ সালে দু বছর শিক্ষানবিস শেষে তার বাবার মৃত্যুর পর বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯০১ সালে বরিশাল রাজচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ড. হরেন্দ্রনাথ এর অনুরোধে উক্ত কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগদেন। ১৯০৬ সালে স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে সম্মানের সাথে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকুরীতে যোগদান করার অনরোধ করলে তিনি আইন পেশা ছেড়ে দিয়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করেন এবং পরবর্তীতে জামালপুর মহকুমার এসডিও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। এসডিও হিসেবে চাকুরী করতে গিয়ে নিজ চোখে জমিদার ও মহাজনদের র্নিমম অত্যাচার দেখেন। এ অত্যাচারের প্রতিকার করতে গিয়ে তিনি তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন এবং ১৯০৮ সালে এসডিওর চাকুরী ছেড়ে দেন। পরে সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক ও মেহনতি মানুষের দূর্বস্থা স্বচক্ষে অবলোকন করেন। সরকারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তিনি এ চাকুরী ও ছেড়ে দেন এবং ১৯১১ সালে পুনরায় কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। তখন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লার নেতৃত্বে তাকে সংম্বর্ধনা দেয়া হয়।
এদিকে ১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গ নিয়ে বাংলার জনগন বিভক্ত হয়ে পড়লে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা সংঘটনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং ১৯০৫ সালে ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় আহসান মন্জিলে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহব্বান করেন। ফজলুল হক সে কনফারেন্সে যোগদান করেন এবং গঠিত কমিটিতে যুগ্ন-সচিবের দ্বায়িত্ব পান। এই কনফারেন্সেই সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলীম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা পাস হয় এবং ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলীম লীগের সুত্রপাত ঘটে। শের-ই-বাংলা ১৯১২ সালে মুসলীম লীগে যোগ দেন এবং বিভিন্ন পদ অলংকৃত করে ১৯১৯ সালে মুসলীমলীগের সভাপতির পদ লাভ করেন।
আবার এদিকে ১৯১৪ সালে শের-ই-বাংলা নিখিল ভারত কংগ্রেসে যোগদান করেন। নানা চড়াই উৎরাই শেষে ১৯১৮ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি সর্বভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯১৩ সালে ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৩ -১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সভায় ১৪৮ বার বক্তৃতা করেন যার মধ্যে ১২৮ বারই তিনি দাড়িয়েছিলেন মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কথা বলার জন্য। তার এ ভূমিকার জন্য তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার ডিপিআই কর্ণেল সাহেব তখন তাকে বাংলার “বেন্থাম” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
বৃটিশ বিরোধী তৎপরতায় শেরে-ই-বাংলার ভূমিকা অনস্বীকার্য। নবযুগ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তিনি এ ভূমিকা রাখেন। সে সময়ে কবি নজরুল নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং বৃটিশ বিরোধী লেখালেখিতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। সে সময় কলকাতা উচ্চ আদালতের ইংরেজ বিচারপতি টিউনন সাহেব তার খাসকামরায় ফজলুল হককে ডেকে ইংরেজ বিরোধী লেখার ব্যপারে হুশিয়ার করে দেন। তাতে কোন লাভ হয়নি, বরং শেরে-ই-বাংলা কবি নজরুলকে ইংরেজ বিরোধী লেখা আরো বেশি করে লিখার জন্য বলে দেন। তাতে পত্রিকাটির জামানত বায়েজাপ্ত হয় এবং বন্ধ হয়ে যায়। ফজলুল হক পুনরায় পত্রিকাটি চালু করেন।তবে তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে নজরুল আর সে পত্রিকায় লেখালেখি করেননি।
১৯২৪ সালে ফজলুল হক খুলনা অঞ্চল থেকে আইনপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং তৎকালীন বাংলার গর্ভণর জেনারেল লর্ড লিটন শেরে-ই-বাংলাকে বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। কিন্তু সরকারের বাজেট সংক্রান্ত ইস্যুতে বনিবনা না হওয়ায় ১৯২৪ সালেই মন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেন।
১৯২৯ সালের ৪ জুলাই বঙ্গীয় আইন পরিষদের ২৫ জন মুসলিম সদস্য নিয়ে শেরে-ই-বাংলা কলকাতায় একটি সম্মেলনে মিলিত হন। ওই সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব করা হয় যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল কৃষকদের উন্নতি সাধন। ১৯৩৪ সালে ঢাকায় এ সম্মেলন হয় তাতে ফজলুল হক সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে সম্মেলনের মাধ্যমে কৃষক প্রজা পার্টির সুত্রপাত হয়।
১৯৩০-৩১ সালে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী Sir James Ramsay MacDonald ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের রুপরেখা তৈরির জন্য গোলটেবিল বৈঠক আহব্বান করেন। মহাত্না গান্ধী সে বৈঠক প্রত্যাখান করেন। তবে মুসলীমলীগ সে বৈঠকে যোগদান করেন এবং ফজলুল হক বাংলা ও পান্জাবের মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্বের দাবী করেছিলেন। ১৯৩১-৩২ সালে আবার ও একই বিষয়ে বৈঠক হয়, তাতে কংগ্রেস যোগদান করলেও সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে কোন সমাধান না হওয়ায় শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব বৃটিশদের হাতে চলে যায়।
১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদ নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির সদস্য হিসেবে পটুয়াখালী থেকে নির্বাচন করে জয়ী হন। নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি পায় ৩৯ টি আসন আর মুসলিম লীগ পায় ৩৮ টি আসন। কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় এবং ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন।
বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করেন। ‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ’-এর পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ‘ফ্লাউড কমিশন’ গঠন করে। ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস হয় এবং জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের পক্ষ হতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এ. কে. ফজলুল হক। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবনা। জনশ্রুতি আছে ওই প্রস্তাবে ফজলুল হক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের নিয়ে একাধিক রাস্ট্রের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু চতুর জিন্নাহ তা চাতুরীর মাধ্যমে পরিবর্তন করে একটি রাস্ট্রের কথা চালিয়ে দেন। তা না হলে গোল টেবিল বৈঠকেই বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হত, শোষন নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করা লাগত না।
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে গঠিত হল যুক্তফ্রন্ট। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি ছিল। তাদের গৃহীত উল্লেখ্যযোগ্য কর্মসূচিগুলো হল:
1. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ।
2. ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।
3. ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে ‘শহীদ মিনার’ নির্মাণ।
4. বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।
5. এলাকায় বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা গবেষণা কেন্দ্র বা বাংলা একাডেমি ঘোষণা করা।
6. জমিদারি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া।
১৯৫৫ এর ৫ জুন সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে পুনরায় গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। মুসলিম লীগের চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। এ. কে. ফজলুল হক ছিলেন ওই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৫৬ এর ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও ২৩ মার্চ তা কার্যকরী হয়। এ সময় এ. কে. ফজলুল হক পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে ৮৩ বছর বয়সে করাচি থেকে ঢাকা এসে ১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তাকে গভর্নরের পদ থেকে অপসারণ করে। এরপরই তিনি তার ৮৬ বছরের বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০ টা ২০ মিনিটে এ. কে. ফজলুল হক ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। ২৮ এপ্রিল সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকার পল্টন ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাকে সমাহিত করা হয়। একই স্থানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের কবর রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলা তথা বাংলাদেশের এই মহান নেতাকে আমরা ভুলে না যাই।
এত গৌরব উজ্জল একজন নেতার জীবনী আমাদের জানানো হত না!!! ছোট বেলায় আমরা ওনি খেতে গেলে কয়টি কই মাছ আর কয়টি মুরগী খেতেন সে গল্পই শুনানো হয়েছিল আমাদের।
লেখকঃ আরিফুর রহমান, সিনিয়র সহকারী সচিব, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়।