Friday, November 22, 2024

চাদঁ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা

নেহাল আহমেদ:মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দর, শিব-মনসা, সনকা-চাঁদ সওদাগর চরিত্রগুলো সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। যে ঢিবির কথা বলা হচ্ছে, জনশ্রুতি বলে, সেটি চাঁদ সওদাগরের স্মৃতিবিজড়িত নৌকার ডুবির স্থান। মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র চাঁদ সওদাগর স্থানীয় লোকজনের সপ্তডিঙ্গা এখানেই ডুবেছিলো।কথিত যাই হোক মনসা মঙ্গল কাব্য ভাষান যাত্রা এই কাহিনীকে বিশ্বাস যোগ্য করে তুলেছে।

চাঁদ সওদাগরের বাস ছিল কোথায়, সে তথ্য ঠিকভাবে কেউ দিতে পারেন না। ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, পাল যুগের একটি চন্দ্র বংশ আরাকান রাজ্য শাসন করে। এই চন্দ্র বংশের প্রভাবশালী রাজা শ্রীচন্দ্রদেবকেই ইতিহাসের চাঁদ সওদাগর বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন, আনোয়ারার বন্দর এলাকার চম্পকনগরে কোটিশ্বর নামক এক রাজার পুত্র ছিলেন চন্দ্রদেব। তাঁর ছিল মধুকর, শঙ্খচূড়া, রত্নাবতী, দুর্গাবর, খরষাং, পাঠানপাগল, গুঞ্জাছড়ি, উদয়তারা, কোড়ামোড়া, কাজলরেখাসহ বিভিন্ন নামের চৌদ্দ ডিঙ্গা। এসব নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতেন। তাই তাঁর নাম হয়ে ওঠে চাঁদ সওদাগর। আবার বগুড়া এলাকায়ই অঙ্গদেশে ছিল চম্পকনগর—এ রকম কথাও প্রচলিত রয়েছে। রাজবাড়ী শহরের ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে রাজবাড়ী -কৃষ্টিয়া মহা সড়কেন চন্দনী নদীর তীরে চন্দনী নামে একটি জায়গায় রয়েছে চাঁদ সওদাগরের নৌকা ডুবির এই ভিটা। জনশ্রুতি যা-ই বলুক,রাজবাড়ীর বয়স্ক স্থানীয় লোকজন দিঘিটিকে চাঁদ সওদাগরের ভিটা হিসেবেই মনে করেন। রজবাড়ী শহর থেকে মাত্র – কিলোমিটার দুরে হড়াই নদীর পাড়ে এই ভিটার অবস্থান। হড়াই নদী এক সময় প্রচন্ড খড় স্রোতা ছিল,এই নদীতে বড় বড় নৌকা চলতো।তার স্বাক্ষী হয়ে নদীটি এখনো বেঁচে আছে। ভিটা নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত নানান কথা। শিক্ষক আরম সিদ্দিকী বলেন, ‘শুনেছি এলাকার কোন কোন মুরুব্বীরা নাকি নৌকার গলুইয়ের দেখা পেয়েছেন।রাজবাড়ী জেলার ইতিহাস বইতে অধ্যাপক মতিয়ার রহমান উল্লেখ করেছেন যে ভাবে বেলগাছি রেলস্টেশন থেকে ৬/৭ কিঃমিঃ দক্ষিণ দিয়ে হড়াই নদী, এখন হড়াই খাল হয়ে ক্ষীণ ধারায় পূর্ব মুখে প্রবাহিত। রাজবাড়ি-কুষ্টিয়ার মহাসড়কে হড়াই খালের উপর বেইলী ব্রিজ। ব্রিজের সন্নিকটে ভবানীপুর গ্রামের পাশে হড়াই তীরে ৩০ থেকে ৪০ গজ একটি উঁচু ঢিবি। লোকে বলে এটা চাঁদ সওদাগরের ঢিবি। চাঁদ সওদাগরকে নিয়ে অত্র এলাকায় একটি প্রবাদ শোনা যায়—– সব নদী খান খান হড়াই নদী সাবধান মঙ্গলকাব্যের নায়ক চাঁদ সওদাগর প্রাচীন ইতিহাসেরও নায়ক। তৎকালীন সময় বাংলার প্রাচুর্য়ের কথা ইউয়ান চোয়াং, ইবনে বতুতা, বার্নিয়ের, টাভার্নার কর্তৃক বিবৃত হয়েছে। ইবনে বতুতা বাংলাকে বলেছেন, প্রাচুর্যের দোজখ। শস্যশ্যামল বাংলায় প্রাচুর্য ছিল কিন্ত অতিরিক্ত গরম এবং রোগব্যাধির কারণে তিনি এমন মন্তব্য করেছিলেন। চাঁদ সওদাগর (কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে একাদশ শতাব্দীর সেন শাসনামলে , কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে চতুর্দশ শতকে সুলতানি শাসনকালে) তার সপ্তডিঙ্গা মধুকরে প্রাচুর্যের দেশের পসার ভর্তি করে শ্যাম (থাইল্যান্ড, মালয় (মালয়েশিয়া) লঙ্কা (শ্রীলঙ্কা), জাভা (ইন্দোনেশিয়া) ইত্যাদি সমুদ্রপাড়ের দেশে বাণিজ্যতে যেতেন। মহাস্থানগড় থেকে সে সব দেশে যাওয়ার পাথ ছিল করতোয়া, হড়াই, গড়াই, কুমার ইত্যাদি। সে সময় পদ্মার প্রবাহ ছিল না। গঙ্গার স্রোত এসব নদী দিয়ে সাগর মুখে ধাবমান ছিল। এ অঞ্চলের সকল নদীর মধ্যে হড়াই ছিল বেশি খরস্রোতা ও ভয়াল। এ কারণে নাকি চাঁদ সওদাগরের মা তাকে হড়াই নদীকে উদ্দেশ্য করে সাবধান করেছিল। কিন্তু বিধি বাম। সেই হড়াই নদীর স্রোতের বাঁকে চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গার (বৃহৎ নৌকা) মধ্যে ৪/৫টি ডুবে যায়। দীর্ঘদিন নৌকাগুলোর সাথে পলি জমে স্তুপাকার ঢিবি আকার ধারণ করে। ঘটনার প্রবাহে গঙ্গার মুখের জলধারার পথের পরিবর্তন ঘটে। পদ্মা, ইছামতি, আড়িয়াল হয়ে ওঠে বেগবান। গঙ্গা যমুনার জলরাশি পদ্মা মেঘনা দিয়ে প্রবাহিত হয়। হড়াই, গড়াই, কুমার মাথাভাঙ্গার ধারা ক্ষীণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে চাঁদ সওদাগরের ঢিবি। চাঁদ সওদাগর কি বিপ্রদাস পিপলাই (১৪৯৫-৯৬) বা বিজয়গুপ্ত (১৪৮৪) রচিত মনসা মঙ্গল কাব্যের কল্পনার নায়ক? নাকি ঐতিহাসিক চরিত্র? খাঁটি বাংলা ভাষা ব্যবহারে সাহিত্য বিকাশের মধ্যে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি রচনার ধারা লক্ষ্য করা যায়। এরমধ্যে মঙ্গলকাব্যসমূহের প্রেমের কাহিনীর বদলে দেব দেবীর মাহাত্ম তুলে ধরা হয়েছে। মনসা মঙ্গলকাব্যে দেখানো হয়েছে শৈব্যধর্মে বিশ্বাসী হলেও চাঁদ সওদাগর কীভাবে সাপের দেবী মনসার পূজা করতে বাধ্য হন। চাঁদ সওদাগর ও তার পুত্র লখিন্দর, পুত্রবধু বেহুলা ও মনসা দেবীকে কেন্দ্র করে কাহিনীর বিন্যাস। অত্র অঞ্চলে কাহিনীটি ‘ভাষান যাত্রা’ বলে পরিচিত। রাজবাড়িতে বিগত শতকে বহু ভাসান যাত্রা দল গড়ে ওঠে এবং গ্রামে গ্রামে সে সব পালাগান অনুষ্ঠিত হত। বর্তমান বগুড়া শহরের অনতিদূরে ‘মহাস্থানগড়’ প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক সমৃদ্ধ স্থান। প্রাচীন বরেন্দ্রভূমির রাজধানী পুণ্ড্রনগর বা গৌড়, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন রাজাদের শাসনস্মৃতি বিজড়িত মহাস্থানগড়। বগুড়া শহর থেকে ১০ কিমি উত্তরে মহাস্থানগড় ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি। এরপূর্বে করতোয়া নদী, পশ্চিমে মহানন্দা। বৌদ্ধ বিহার, মুর্তি, বেহুলার বাসর ঘর, শীলাদেবীর ঘাট, জিয়ৎ কুণ্ডু, কালীদহ সাগর, সুলতান সাহেবের (মাহসওয়ার) মাজার, বোরহান উদ্দিন (রাঃ) এর মাজার, পদ্মাদেবীর নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এখনো খনন কাজ চলছে। মহাস্তানগড় হতে দক্ষিণ পশ্চিমে এবং বেহুলার বাসরঘর হতে প্রায় ২ কিমি পশ্চিমে চাঁদ সওদাগরের বাড়ি চম্পক নগর।

বর্তমানে চাপাইনগর বলে অবস্থিত স্থানে এর ধবংসাবশেষ বিদ্যামান রয়েছে। চাঁদ সওদাগর ছিলেন শিবভক্ত শৈব্য। শিবের শক্তি অসীম। শিব একক শক্তির অধিকারী। সর্পদেবী মনসাকে (পদ্মাদেবী) সে পূজা দিতে নারাজ। হে হাতে পুজেছি আমি দেব শূলপাণি হে হাতে পূজিব আমিহাতে পুজেছি আমি দেব শূলপাণি হে হাতে পূজিব আমি বেঙ খাকী কাণী এতে মনসা দেবী বাগান্বিত হয় এবং পুজো না দেওয়ায় প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। ধনকুবের সওদাগর ছয়পুত্রসহ বিদেশ থেকে বাণিজ্য করে বাড়ি ফিরছিলেন। সপ্তডিঙ্গা কালীদহের সাগরে এলে মনসা দেবী কালীদহে কৃত্রিম ঝড় তোল।

 

লেখক- সাংবাদিক ও কবি নেহাল আহমেদ..

সর্বশেষ পোষ্ট

এই ধরনের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here