স্টাফ রিপোর্টারঃ আলোচিত মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ৬০ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা ‘জল্লাদ’ শাহজাহান ভূঁইয়া মারা গেছেন। সোমবার ভোরে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
শাহজাহানের বোন ফিরোজা বেগম মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সাভারে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। আজ ভোর রাত ৩টার দিকে হঠাৎ করেই বুকের ব্যথা অনুভব করলে তাকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোর ৫টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ ঘাতক, ৬ জন যুদ্ধাপরাধী, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামি খুকু মনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানসহ আলোচিত ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন শাহজাহান। ২০০১ সাল থেকে তিনি ফাঁসি কার্যকর শুরু করেন।
শাহজাহান ভূঁইয়া নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম হাছেন আলী ভূঁইয়া। নানান অপরাধে গ্রেপ্তারের পর শাহজাহান ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে যান।
শাহজাহানের জন্ম ১৯৫০ সালে। কারাগারের নথি বলছে ১৯৯২ ও ৯৫ সালের দুটি ডাকাতি ও হত্যা মামলায় তার মোট ৪২ বছরের কারদণ্ড হয়। পরে সেই সাজা কমে ৩২ বছর করা হয়। প্রতি ফাঁসি কার্যকরের জন্য দুই মাসের সাজা রেয়াত পেয়েছেন নামের আগে ‘জল্লাদ’ পরিচিতি বসা শাহজাহান। এই হিসাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেই তার সাজা কমেছে সোয়া চার বছর। আর ভালো আচরণ এবং অন্যান্য কারণে কারাবিধি অনুযায়ী কমেছে আরও কিছু সাজা।
কে এই শাহজাহান- ?
শাহজাহান ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরিচিতি পান ‘ডাকাত’ হিসেবে।
শাহজাহারের তিন বোন, এক ভাই। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া ও মা মেহের। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত। ১৯৭৪ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন। নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন শাহজাহান। জেলে যাওয়ার সময় অবিবাহিত ছিলেন তিনি।
একবার তার গ্রামে নারীঘটিত ঘটনায় দুই বন্ধুসহ শাহজাহানের নামে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে গ্রামে বিচারে বসে। বিচারে অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় সাজা হয় তার। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে বদলা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেনে। অপরাধ জগতে জড়িয়ে চরম প্রতিশোধ নেয়ার খেলায় মেতে ওঠেন তিন।
সেই ধারায় ক্রমেই দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী তালিকায় নাম উঠে যায় শাহজাহানের। তার উল্লেখযোগ্য একটি ডাকাতির অপারেশন ছিলো ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়। আর এটাই ছিলো তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। কারণ, এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তে হয় তাকে।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে যান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয় কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন, পথিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই সমাপ্তি এবং এরপর থেকে তার বন্দী জীবন শুরু।
রেকর্ড অনুযায়ী দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত শাহজাহান ভূঁইয়া। একটি ডাকাতি করতে গিয়ে হত্যা মামলা এবং আরেকটি অস্ত্র আইনে মামলা। এ দুটি মামলায় ১৯৯১ সালের ১৭ মে থেকে কারাগারে আছেন। দুই মামলায় তার সাজা হয়েছিল ৪২ বছর।
এর মধ্যে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে অস্ত্র আইনে মামলায় তার ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার অনাদায়ে আরও ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। আর হত্যা মামলায় তার ৩০ বছরের সাজা হয় এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাস কারাদণ্ড হয়।
এই দুই মামলায় ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন রেয়াত পেয়েছেন তিনি। শাহজাহানের হাতে কোনো টাকাপয়সা না থাকায় যে ১০ হাজার টাকা তাঁর দণ্ড হয়েছিল, তা কারা কর্তৃপক্ষ মিটিয়ে দিয়েছে।
সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে শাহজাহান জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এরপর কারাগারে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় আসলেই ডাক পড়তো তার। টানা আট বছর এই কাজ করার পর কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেন।
বন্দী জীবন থেকে বেরিয়ে শাহজাহান ভূঁইয়া নতুন জীবন শুরু করেছিলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকায়। সেখানে একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। ২৩ বছর বয়সী এক তরুণীকে বিয়েও করেছিলেন। কিন্তু তার সেই সুখের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সাথী আক্তার নামের ওই তরুণীকে বিয়ে করেন শাহজাহান। কিন্তু ৫৩ দিনের মাথায় তার ঘর ছেড়ে চলে যান সাথী।’