Tuesday, December 24, 2024

নুরজাহান বেগমের প্রশ্ন মৃত্যুর আগে কি বীরঙ্গনার স্বীকৃতি পাবো?

নুরজাহান বেগম ‘১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। কিশোরী হলেও আমাকে রেহাই দেয়নি রাজাকাররা। একটি বন্ধ ঘরে বিহারিরা আটকে রাখে তাকে। রাত হতেই নরপশুরা হায়নার মত তার উপর হামলে পড়তো। চিৎকার করে অনেক কেঁেদছি, বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি কেউ আমাকে।’কি নির্মমই না ছিল দিনগুলো। এভাবেই সেদিনের কথাগুলো বলতে বলতে দু,চোঁখ দিয়ে অঝোড়ে ঝড়ছিল পানি।
তিনি বলেন, ‘দিনে এক বেলা অথবা দুই বেলা খাবার দিতো তারা। প্রায় দুই মাস অসহায় অবস্থায় অমানবিক নির্যাতন সইতে হয়েছে আমাকে। আমার মত আরো ১২/১৩ জন মহিলাকে সে সময় আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তার মধ্যেই দুই জন মারাও যায়। যারা বেঁচে ছিলাম তারা প্রতিনিয়ত ডাকতাম বিধাতাকে। বলতাম এই হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা কর তুমি। বিধাতা হয়তো আমার কথা শুনেছেন কিন্তু দেরিতে, দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে হায়নাদের পরাজিত করে এবং আমাকে উদ্ধার করে।’ নুরজাহান বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দেবার পর শুরু হয় তার আরেক যুদ্ধ। টানা এক মাস চিকিৎসা নিতে হয় তাকে। সুস্থ হওয়ার পর প্রতিবেশীরা সামনে কিছু না বললেও আড়ালে আবডালে কটূ কথা বলতো। তিনি বলেন, ‘আমাকে নিয়ে মা এবং ছোট ভাইও করতো সব সময় চিন্তা। নরপশুদের হাত থেকে জীবনে বেঁচে থাকা এই আমাকে কে করবে বিয়ে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় মা ও ছোট ভাইকে মারপিট করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা। ১৩ বছরের নুরজাহানকে তারা তুলে দেয় বিহারিদের হাতে। এর পরের দুঃসহ যন্ত্রণা আর নির্যাতন চলে তার ওপর।
মুক্তিযুদ্ধের পরপর এই নির্মম নির্যাতনের কথা বলতে চাননি নির্যাতিতরা। কিন্তু সামাজিক মনোভাব পাল্টেছে। এখন বীরাঙ্গনাদেরকে সম্মানের চোখে দেখে সমাজ, দেখে রাষ্ট্র। এতদিন পরে এসে বীরাঙ্গনাদের ত্যাগের স্বীকৃতি মিলেছে। এখন তারা মুক্তিযোদ্ধা। তবে ৭১ এর বন্দী, নির্যাতিতা নুরজাহান এখনও স্বীকৃতি পাননি।
দেখতে দেখতে নুরজাহানের বয়স হয়ে গেলো ৬০। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। পেয়েছে মৃত্যুচিন্তা। আশা করে বসে আছেন, মৃত্যুর আগে পাবেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তাও বিভিন্ন অফিসের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে তার জুতা ক্ষয় হয়েছে অসংখ্য। তার প্রশ্ন মৃত্যুর আগে কি মিললে বিরঙ্গনার স্বীকৃতি?

তবে সবাই তো আর সমাজে একভাবে ভাবেন না। ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা চৌগাছি গ্রামের মোকাররম মোল্যার সঙ্গে বিয়েও হয় তার। তবে স্বামীর বাড়িতে ঠাঁই হয়নি। কারণ, ওই পরিবারের লোকজন তাকে মেনে নিতে পারেননি। পরে স্বামীকে ছেড়ে আসতে হয়েছে তার বাবার বাড়ী। স্বামীও তাকে ছেড়ে যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের পর পর লোকলজ্জায় কুঁকড়ে থাকলেও এখন নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন নুরজাহান। তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য আমার সবকিছু দিয়েছি। শুনেছি ও পেয়েছি মানুষের তাচ্ছিল্ল। এতে আমার কোন দুঃখ নেই। আমি সব সময় দেশের মঙ্গল কামনা করি। দেশ এগিয়ে যাক এটাই আমার কমনা। ’
ভাইয়ের দেয়া ১২ শতাংশ জমিতে একটি কোনে ঘর তুলেছেন নুরজাহান। চার মেয়ের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলেকে পাঠিয়েছেন দেশের বাইরে।
সরকারি ১০ শতাংশ খাস জমি দিলেও তার দখল আজও বুঝে পাননি নুরহাজান। বলেন, ওই জমির দখল নিতে গেলে প্রভাবশালীরা নানাভাবে হুমকি দেয়।
দেখতে দেখতে বয়স হয়ে গেলো ৬০। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। পেয়েছে মৃত্যুচিন্তা। বিদায়ের আগে চান রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। জানান, বীরঙ্গনার স্বীকৃতির দাবিতে কর্তা ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও কোন স্বীকৃতি মেলেনি।

অনেক বড় মনের মানুষ নুরজাহানের স্বামী মোকাররম হোসেন। তিনি বলেন, ‘বয়সে কিশোর হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মাগুরার চৌগাছিতে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সহযোগিতা করেছি। তাই মুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গনাদের প্রতি ছিল আমার শ্রদ্ধা।’
মোকাররম বলেন, ‘নুরজাহানের বাড়ীর পাশে ছিল আমার এক চাচাতো বোনের বাড়ি। ১৯৭৩ সালে ওই চাচাতো বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে দেখা হয় বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তাদের কাছ থেকেই নুরজাহান সম্পর্কে জানতে পারি। তার উপর আমার মমতা সৃষ্টি হয়। আমি তাকে বিয়ে করি।’
নুরজাহানের স্বামী বলেন, ‘ বিয়ের পর নানা জনের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে কটূকথা। তবে আমার বাবা, মাও আমাদের এই বিয়ে মেনে নেননি। কোন উপায় না দেখে শ্বশুরালয়েই বসবাস শুরু করি।’
নুরজাহানের স্বামী বলেন, ‘নরপশুরা নুরজাহানকে ধরে নিয়ে গেছে, করেছে অত্যাচার। এটিতো তার দোষ নয়। যারা এমনটি করেছে তাদের দোষ। আমি মানুষ। তাই মনুষ্যত্ববোধ থেকেই আমি নুজাহানের পাশে দাঁড়িয়েছি। তাছাড়া সে তো খুব ভাল মেয়ে। একজন ভাল মানুষকে ভালোবাসাইতো মানুষের প্রধান ধর্ম।’
নুরজাহানের ছোট ভাই কোবেদ সেখ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ছনের ঘরের মাটির ডোয়ায় আমি ‘জয় বাংলা’ লিখেছিলাম। আর এটিই ছিল আমার অপরাধ। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে রাজকাররা আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। করে লুটপাট। আমার মাকে রাইফেল দিয়ে করে তারা আঘাত। আর হাত বাঁধে আমার। সে সময় আমাদের চোখের সামনে তারা নুরজাহানকে তুলে নিয়ে যায়।’
কোবেদ সেখ জানান, এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ, খলিলুর রহমান, আব্দুল লতিফ, শহর আলীসহ তাদের সঙ্গীরা ১৭ ডিসেম্বর জেলা শহরের বিহারি কলোনিতে (বর্তমান নিউ কলোনি) অপারেশন চালায়। এ সময় তারা নুরজাহানকে উদ্ধার করে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, নুরজাহানকে আমিসহ মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে বাড়ীতে নিয়ে আসি। সে আসলে একজন প্রকৃত বীরঙ্গনা। তার স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মতিন ফেরদৌস বলেন, ‘নুরজাহান বেগম একজন বীরঙ্গনা। তাকে সম্মান জানানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাই আমি।’

সর্বশেষ পোষ্ট

এই ধরনের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here