ঢাকা, ৭ জুন, ২০২৪ (বাসস) : প্রস্তাবিত বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক ও কর কমানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘আমরা যেসকল পদক্ষেপ নিয়েছি তার ফলে আগামীতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে এটা আমি আপনাদের দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই।’
তিনি জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ যেহেতু এখন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, তাই সংকোচনমূলক নীতি-কৌশল আরও কিছু দিন চলতে থাকবে।
শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের সূচনা বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন অর্থমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চে অর্থমন্ত্রীর ডান পাশে বসেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার।
মঞ্চে অর্থমন্ত্রীর বাঁ পাশে বসেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে বসা মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী এবং এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থসচিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গতকাল জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির আওতায় গৃহীত পদক্ষেপ উল্লেখ করা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, কর কাঠামোতে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো হয়েছে। সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতি থেকে সুরক্ষা দিতে ওএমএস এবং ফ্যামিলি কার্ডসহ যেসব কার্যক্রম চলছে তা চলমান থাকবে এবং প্রয়োজনে এগুলোর পরিসর আরও বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে,তাঁর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কি-না সাংবাদিকরা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থসচিবকে প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেন।
অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান এসময় বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবার বাজেট সংকোচনমূলক করা হয়েছে। এছাড়া একমাসে আগে যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়, সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মুদ্রানীতিতে সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। এটা মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। এছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের জন্য বাজেটে যথাযথ বরাদ্দ থাকছে। এর বাইরে টিসিবির এককোটি ফ্যামিলি কার্ডধারী রয়েছেন। এসব নীতি-কৌশলের কারণে তিনি আশাবাদী মুল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসবে এবং আগামী অর্থবছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থসচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, অর্থনীতি সংকোচিত হয়েছে, এমন কথা একেবারে ঠিক নয়। তবে এবার আমরা সংকোচনমূলক বাজেটের প্রস্তাব করেছি, যেহেতু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আমাদের মূল লক্ষ্য। না হলে বাজেটের আকার আরও বাড়ানো যেতো।
তিনি আরও বলেন, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা।এবারের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। তাই যদি দেখেন এবারও বাজেটের আকার বৃদ্ধির হার কম নয়।
দ্রব্যমূল্যের ওপর যাতে কোনো চাপ না পড়ে সে জন্য বাজেটের আকার কমিয়ে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমরা আশা করছি, এ বছরের শেষের দিকে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। এবার আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, বাজেটের আকার আমরা কমিয়ে রেখেছি যাতে দ্রব্যমূল্যের ওপর কোনো চাপ না পড়ে।’
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি এখনও ৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। বৈশ্বিক কারণে মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ায় টাকার মান কমেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার জন্য এটা একটা কারণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, নিয়েছি। আরও যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন আমরা নেব।
ব্যাংকের তারল্য সংকটের সময়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন, এতে ব্যাংকে তারল্য সংকট হবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এটা সব বাজেটেই সব অর্থমন্ত্রীরা করে থাকেন। সব সরকার করে থাকে। উন্নত দেশে আরও অনেক বেশি নিয়ে থাকে, আমরা তো মাত্র ৫ শতাংশের মধ্যে এটা ধরে রেখেছি। কাজেই এটা এতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।
প্রস্তাবিত বাজেটের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন একজন সাংবাদিক এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এফবিসিসিআই, ঢাকা চেম্বারসহ কোন ব্যবসায়ী সংগঠন বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এমন আশঙ্কার কথা জানাননি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করেন। উপদেষ্টা বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট অত্যন্ত সুবিবেচিত এবং ভারসাম্যপূর্ণ। যেখানে প্রবৃদ্ধিকে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, যেন অর্থনীতির আকার বাড়ে এবং অর্থনীতির অন্যান্য দিকগুলোও সুসংহত ও শক্তি সামর্থ্যবান হয়। সেদিকে নজর রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেটের সার্বিক দিকনির্দেশনা স্পষ্ট করা আছে। বাজেটে আগে কখনও এত সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি।
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে মসিউর রহমান বলেন, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের সম্পদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তথ্য অনুসন্ধান করছে। তথ্য অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষের পর তাঁর বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মূলস্ফীতি সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, যখন কোন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয়, তখন মূল্যস্ফীতি ঘটে। আমাদের সমস্যাটা সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ে নয়, সমস্যাটা হলো-খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি, সেটা কিন্তু পাশর্^বর্তী দেশসমূহের মূল্যস্ফীতির কাছাকাছি। দেখতে হবে আমরা যেসব দেশ থেকে নিত্যপণ্য আমদানি করছি, সেখানে দাম বেড়েছে। পরিবহন খরচ বেড়েছে।
সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে বাজেটে কোনো উদ্যোগ আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সুনীল অর্থনীতির গবেষণায় ও অন্যান্য বিষয়ের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম জানান,তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর সয়াবিন তেল, পেঁয়াজসহ বেশ কিছু নিত্যপন্যের দাম কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জনবল বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, জনবল নিয়োগের বিষয়ে এনবিআর থেকে চিঠি এসেছিল। ইতোমধ্যে আমরা ব্যাপক জনবল বৃদ্ধি করেছি। আশা করছি সামনে আরও বৃদ্ধি করা হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অটোমেশনের বিষয়টি শুরু হয়েছে। অর্থবিভাগ থেকে আমরা জনবল নিয়োগের বিষয়ে অনুমোদন পেয়েছি।
কর প্রদানের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বিভিন্ন কারণে মানুষের হাতে অপ্রদর্শিত কিছু সম্পদ থাকতে পারে। অনেক সময় অজ্ঞতার কারণে রিটার্নে কিছু সম্পদ দেখানো হয় না কিংবা অন্যের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দেয়ার কারণে এমন ঘটনা ঘটে। জমি ক্রয়-বিক্রয়ের কিছু টাকাও অজ্ঞাত কারণে অপ্রদর্শিত থেকে যায়। তিনি বলেন, ডিভিএস-এর মাধ্যমে আমরা কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে চাচ্ছি। তাই ব্যবসায়ীমহল ও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে অনুরোধ ছিলো- অডিটের ভুলত্রুটি শোধরাতে তাঁদের সুযোগ দেওয়ার জন্য। এজন্য আমরা এই সুযোগ দিয়েছি। অনেক দেশে প্রদর্শিত অর্থ এভাবে বৈধ করার সুযোগ আছে বলে তিনি জানান।