নেহাল আহমেদ: রাজার বাড়ীর শেষ দিগুলোর পুজা উৎযাপনের প্রত্যক্ষদর্শী দুলাল দত্ত জানান তখন পুজার ১০৮ টি খাসি কাটা হত তৈরি হতো নানান মিটান্ন দ্রব্য। মিষ্টি ছাড়া তো পূজার আয়োজন অসম্পূর্ণ। খাবারের শেষে মিষ্টি না হলে কি চলে? ছানার সন্দেশ, রসগোল্লা, মিষ্টিদই, ক্ষীর থাকত পূজার খাবারের আয়োজনে। এছাড়াও প্রসিদ্ধ পূজার খাবারের মধ্যে থাকতো হাতে তৈরি বিভিন্ন রকম নাড়ু, তালের বড়া, দুধপুলি পিঠা ও মিষ্টি। আরও থাকে পদ্মচিনি, চিনি সন্দেশ ও বাতাসা।পুজার আগে থেকেই এগুলো তৈরি করা হতো।
রাজার সুর্যকুমারের ঘনিষ্ঠজন আমার স্মৃতিকথায় ত্রৈলোক্যনাথ লিখেছেন – কাশিমনগর পরগনার পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চল, (পদ্মা তখন লক্ষমীকোল থেকে ৬ মাইল/প্রায় ১০ কিমি উত্তর দিয়ে প্রবাহমান ছিল), সূর্যনগর, দিনাজপুর, ভুবেনেশ্বর, কলিকাতা, কাবিলপুর পরগনায় সূর্যকূমারের জমিদারী প্রতিষ্ঠা পায়। এ সকল জমিদারী থেকে লক্ষীকোল এস্টেটের বাৎসরিক আয় তখনকার দিনে ছিল প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। রাজপ্রাসাদ ও রাজার বাড়ীর নাম ছিল দেশখ্যাত। প্রায় ৬০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদ, অতিথিশালা, পোস্ট অফিস, আঙীনা, বাগানবাড়ী, শান বাধানো পুকুর “ঘাট, টোল, বৈঠকখানা, অফিস কর্মচারী, পাইক পেয়াদা, গোশালা, আস্তাবল নিয়ে রাজার বাড়ী ছিল জমজমাট।
প্রদক্ষদশীরা জানান দোতলা বিশাল এই জমিদার বাড়িতে অনেকগুলো কক্ষ ছিলো যার প্রায় সবগুলোতেই পাবেন কারুকার্যের ছোঁয়া। এই জমিদার বাড়ীতে ছিলো কাছারিঘর, অতিথিশালা, নাচঘর, পুজা মণ্ডপ, বৈঠকখানা, ভাঁড়ার সহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা অংশ।হাতিশালে হাতি থাকতো ঘোড়াশালে ঘোড়া ১৯৫৪ সালের রাজবাড়ী রাজার দুর্গাপূজার তথ্য কথা জানা গেলেও তার আগ থেকে এই প্রাসাদে পুজা হতো আর এটিই সম্ভবত রাজবাড়ী প্রাচীনতম দুর্গোৎসব।
রানী মাতা শরৎ সুন্দরী শুদ্ধাচারে রাজবাড়ী দুর্গাপূজা তদারকি । তিনি অতিথিদের চিত্তবিনোদনের দেশীয় প্রজাদের বিনোদনের জন্য পূজা উপলক্ষে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন।
রাজার বাড়ীর শেষ দিগুলোর পুজা উৎযাপনের প্রত্যক্ষদর্শী দুলাল দত্ত জানান তখন পুজার ১০৮ টি খাসি কাটা হত তৈরি হতো নানান মিটান্ন দ্রব্য। মিষ্টি ছাড়া তো পূজার আয়োজন অসম্পূর্ণ। খাবারের শেষে মিষ্টি না হলে কি চলে? ছানার সন্দেশ, রসগোল্লা, মিষ্টিদই, ক্ষীর থাকে পূজার খাবারের আয়োজনে। এছাড়াও প্রসিদ্ধ পূজার খাবারের মধ্যে রয়েছে হাতে তৈরি বিভিন্ন রকম নাড়ু, তালের বড়া, দুধপুলি পিঠা ও মিষ্টি। আরও থাকে পদ্মচিনি, চিনি সন্দেশ ও বাতাসা।পুজার আগে থেকেই এগুলো তৈরি করা হতো।
এবং পুজায় পুরোহিত ছিলেন তারা শঙ্কর চক্রবর্তী। বাড়ীর পুজা রাজমহলে রানি মা নিজেই তদারকি করতেন। দুর্গাপূজার আয়োজন ছিল অনেক বড়।কলকাতা থেকে নাম করা শিল্পিরা আসতেন। নানান বিনোদনের ব্যবস্থা ছিলো, পুতুল নাচ হতো ছিলো যাত্রা পালা।সারারাত আমরা যাত্রা দেখতাম।আমরা তখন শরৎ সুন্দরী স্কুলে পড়তাম। এখন যেটা লক্ষীকোল সরকারী স্কুল সেটাই ছিলো শরৎ সুন্দরী স্কুল।তিনি বলেন একবার পুজার যাত্রায় ছায়া বিশ্বাস এসেছিলেন অভিনয় করতে।
সচরাচর রাজা বাদশাদের যে রকম ভাবে অত্যাচারী হিসাবে বইতে উপস্থাপন করা হয় তার বিপরীতে রাজা সূর্যকুমার একজন তেজন্বী অথচ কোমল হৃদয়ের মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। প্রতাপশালী বৃটিশের কাছে তিনি মাথা নোয়াবার পাত্র ছিলেন না। স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলনে পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। জাতীয় চেতনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। একবার বড়লাট অত্র এলাকার সকলকে বলছিলেন “তিনি একজন রাজা বটে? অনেকে মনে করেন সেই ঘটনা থেকে রাজা বলে পরিচিত কিন্ত ব্যাপারটা এমন নয়। সূর্য কূমারের ব্যক্তিত্ব, জনহিতকর কাজ, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ এবং প্রজা প্রেমের জন্য ১৮৮০’র দশকে করোনোশনের মাধ্যমে তাকে ‘রাজা’ উপাধি প্রাপ্ত হন।
তখনকার দিনে হয়দিনাক সোহানী কবিরের লেখা ‘পূর্ববাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় রাজবাড়ীর পুজা সম্পর্কে কিছু জানা যায়।তিনি জানান ১৯২৭ সালের ১ অক্টোবর গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি তৃতীয় শ্রেণির ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। পূজা উপলক্ষে ছিল এই বিশেষ ব্যবস্থা। গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত ১২৮ মাইল দূরত্বের জন্য নামমাত্র ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।মাথাপিছু চার টাকা মাত্র।
এই বিশেষ ট্রেনটি চারটি স্টেশনে থামার ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ছাড়া কলকাতা পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া, প্রধান দর্শনীয় স্থানের জন্য গেটের ভাড়া, কালীঘাটের জন্য পূজার ফি, রেলওয়ে নির্মিত নিজস্ব সিনেমার একটি টিকিট ছাড়াও তিন বেলা ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা করে। উল্লেখ্য, উক্ত ট্রেনে যে ৬৩৯ জন যাত্রী ভ্রমণ করে, তন্মধ্যে ৬১৯ জন ইতিপূর্বে কখনো কলকাতায় যায়নি এবং ১৩০ জনের সেটাই ছিল প্রথম রেলযাত্রা। ১৯২৭ সালের পর থেকে প্রতিবছর অক্টোবর মাসে পূজা উপলক্ষে এই ট্রেনের যাত্রা অব্যাহত থাকে। ইত্যবসরে ব্রিটিশ আমল পার হয়ে পাকিস্তান আমল কেটেছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পর সেই তৃতীয় শ্রেণির ট্রেন, সিনেমার টিকিট আর তিন বেলা ফ্রি খাওয়ার এখন শুধুই স্মৃতি।রাজবাড়ী জেলায় এখন অনেক জায়গায় দুর্গা পুজা হয়। রাজার বাড়ীর পুজা এখন শুধুই ইতিহাস অথবা অধরা।