Monday, November 25, 2024

রেলের কথা

নেহাল আহমেদ: এখন রাজবাড়ী থেকে রেলওয়ে ট্রেনে ঢাকা যাওয়া যাবে সরাসরি।যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নয়ন।কিন্ত একশ বছর আগে ঢাকা যেতে হলে কি করতে হতো কেমন ছিলো ট্রেনের যোগাযোগ ব্যবস্থা?

কলকাতা আর পূর্ববঙ্গের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব’ রক্ষায় একমাত্র রাজবাড়ী ছিলো গুরুত্বপুর্ণ। গোয়ালন্দের ভূমিকা অপরিসীম। ১৮৬২ সালে শিয়ালদা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত চালু হয় রেল চলাচল। আর, তার ন’বছর পরেই, কুষ্টিয়া থেকে রেলপথ সম্প্রসারিত হয় গোয়ালন্দ পর্যন্ত। সেটা ১৮৭১। তখন থেকেই, ঢাকা থেকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য গোয়ালন্দ ছিল প্রধান ভরসা।জানিনা কোন কারণে পদ্মা সেতু গোয়ালন্দ দিয়ে হলো না।পদ্মা সেতু গোয়ালন্দ পাটুরিয়াও হতে পারতো।আমার বিশ্বাস তাতে খরচ অনেক কমে যেতো।তাছাড়া কলকাতা পর্যন্ত রেললাইন তৈরিই ছিলো।এখনোও রাজবাড়ী টু মেদেনীপুর বছরের নিদিষ্ট দিনে একটা ট্রেন চলাচল করে।

গোয়ালন্দের ষ্ট্রিমারের খাবারের কথা সৈয়দ মুজতবা আলী, ধীরাজ ভট্টাচার্য লিখে গেছেন।গোয়ালন্দের বহু স্মৃতি বহু বইতে পাওয়া যায়। কোলকাতা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ ঘাটে এসে ষ্ট্রিমারে ঢাকা যাওয়ার স্মৃতি গুলো এখনকার অনেকেই আমরা জানি না। এক সময় জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের ফেরিঘাট যে ঘাট দিয়ে ট্রেন পারাপার চালু হয়েছিলো হয়তো অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য। আজ যে যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হলো একশ বছর পর কি এসব শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে?

গোয়ালন্দের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানতে লিখা কষ্টকর আগের বইপত্র হারিয়ে গেছে। তথ্য পাওয়া কষ্টকর।মানিক বাবুর পদ্মানদীর মাঝি চরিত্রের সব কলাকুশলীই গোয়ালন্দ কে ইতিহাস করে রাখবে। গোয়ালন্দের পুজা, ইলিশ মাছ, ষ্ট্রিমারের হাকডাক কিছুই এখন আর নেই।বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাস ও রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ নামক কবিতায় সেকালের গঙ্গাসাগর তীর্থযাত্রার যে ক্লান্তিকর ও বিপদসংকুল ছবি আঁকা হয়েছে।

সেই পরিস্থিতির যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে।সুনীল কুমার মুনশির ‘পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকে জানা যায় বিশ শতকের গোড়ায় বড় বড় স্টিমার স্টেশন দিয়ে প্রতি মাসে যাতায়াতের পরিসংখ্যান। নারায়ণগঞ্জ ছিল তালিকার শীর্ষে।যাতায়াতের পরিসংখ্যানে তৃতীয় হলেও অবস্থানগত কারণে নদীপথে গোয়ালন্দ ঘাটের গুরুত্ব ছিল ততোধিক। পদ্মা নদীর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ঢাকাসহ যেকোনো জেলার মানুষের জন্য গোয়ালন্দ ছাড়া কলকাতা যাওয়ার পথ ছিল না। কলকাতা তখন অবিভক্ত বাংলার রাজধানী।

আধুনিক সাহিত্যের চর্চা, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা—সবকিছুরই কেন্দ্রভূমি ছিল কলকাতা।যার কারনে কোলকাতার পুজা অর্চনা, শিল্প সংস্কৃতি আমাদের সাথে জড়িত।এপার বাংলার অনেকেই ওপার বাংলার রাজনীতি সাহিত্য সাংস্কৃতিতে বিশেষ অবদান রেখেছেন। ঠিক তেমনি ওপার বাংলার অনেকেই এপার বাংলার গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তি হিসাবে স্থান করে নিয়েছেন।

সে সময়ের গোয়ালন্দ কেন্দ্রিক যে টুকু তথ্য জানা যায় তার কিছু অংশ তুলে দিলাম।

দিনাক সোহানী কবিরের লেখা ‘পূর্ববাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯২৭ সালের ১ অক্টোবর গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি তৃতীয় শ্রেণির ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। পূজা উপলক্ষে ছিল এই বিশেষ ব্যবস্থা। গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত ১২৮ মাইল দূরত্বের জন্য নামমাত্র ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। মাথাপিছু চার টাকা মাত্র। এই বিশেষ ট্রেনটি চারটি স্টেশনে থামার ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ছাড়া কলকাতা পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া, প্রধান দর্শনীয় স্থানের জন্য গেটের ভাড়া, কালীঘাটের জন্য পূজার ফি, রেলওয়ে নির্মিত নিজস্ব সিনেমার একটি টিকিট ছাড়াও তিন বেলা ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা করে।

বর্তমানে রাজবাড়ী রেল ষ্টেশনের পাশে যে জলাধার রয়েছে এখানে পুজার সময় তৈরি হতো ভাসমান অপেরা।সেই অপেরার কলকাতা থেকে কলাকুশলীরা এসে যাত্রা নাটক মঞ্চায়ন করতো।জলের উপর ষ্টেজ করে সেখানে বিনোদনের ব্যবস্থা করা হতো। আজাদী ময়দান নামে রেলের যে ক্লাব গড়ে উঠেছে তারপাশে অনুষ্ঠিত হতো দুর্গাপুজা। ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স, বি সি এলেনের (১৯১২) তথ্য মোতাবেক নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত ডেসপাচ স্টিমারের সময় লাগত ছয় ঘণ্টা। আর ধীরগতির স্টিমারগুলো ১৫ ঘণ্টায় পৌঁছাতে পারত। এই ধীরগতির স্টিমারগুলো কমলা ঘাট, ষাটনল, বাহার, সুরেশ্বর, তারপাশা (লৌহজং), মাওয়া, কাদিরপুর (ভাগ্যকুল), নারিসা, মৈনট, জালালদি, কেননাপুর ও গোয়ালন্দ যেত। নেভিগেশন কোম্পানিগুলো কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ প্লেজার ট্রিপেরও ব্যবস্থা করত সময় সময়।

এক সময় গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশন দিয়ে সেকালে আসামের চা–বাগানে শ্রমিক পাঠানো হতো। সে জন্য এখানে একটি ডিপোর ব্যবস্থা ছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট, এজেন্ট এবং মেডিকেল ইন্সপেক্টররা এখানে চা–শ্রমিকদের বহির্গমন ও অভিবাসনের কাজ তদারক করত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তারা দেশত্যাগ করেছিলেন ভাগ্যের সন্ধানে। আসাম এসেছিলেন নৌপথে, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় ব্যবহার করেন ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত আসাম-বেঙ্গল রেললাইনের পথ। তাদের ট্রেনমার্চ দমন করার জন্য চা মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশে ব্রিটিশ সরকার রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

শ্রমিক নির্যাতনের এক লোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী এই গোয়ালন্দ ঘাট। এ প্রসঙ্গে প্রদোষ চৌধুরী তাঁর ‘সমাজচিত্রে ভারতীয় রেল’ গ্রন্থে লিখেছেন, আসামের চা–বাগানের কুলিরা দীর্ঘ বঞ্চনা, শোষণ সহ্য করতে না পেরে দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করে।

চা–শিল্পের মালিকেরা একজোট হয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে কুলিদের টিকিট বিক্রি বন্ধের অনুরোধ জানায়। বাধ্য হয়ে কুলিরা হেঁটেই দেশে চলে যাওয়ার সংকল্প গ্রহণ করে। ক্ষুধার্ত ক্লান্ত অবসন্ন কুলিরা চাঁদপুর এবং গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটে রাতে বিশ্রামের জন্য উপস্থিত হয়। ১৯২১ সালের ২০ মে প্ল্যাটফর্মে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সপরিবার ঘুমিয়েছিল কুলিরা।

মাঝরাতে কোনো রকম উত্তেজনা ছাড়াই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদপুরের নির্দেশে ব্রিটিশ অফিসাররা এবং গোর্খা চৌকিদাররা নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অসহায় হাজার হাজার কুলি পরিবার। যুগে যুগে সামাজিক ইতিহাসের পরতে পরতে এভাবেই স্থান করে নিয়েছে গোয়ালন্দ। কিছু তথ্য পাওয়া গেছে আরো কিছু তথ্য সংগ্রহ করে ভাসমান অপেরা নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা থাকলো সেই ইতিহাসের অংশ জানলে হয়তো রাজবাড়ী জেলার ইতিহাস ঐতিহ্যের অন্য কোন দ্বার উন্মোচন হবে।

নেহাল আহমেদ কবি ও সাংবাদিক

সর্বশেষ পোষ্ট

এই ধরনের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here