Monday, November 18, 2024

সফলতা নিয়ে বেড়ে উঠা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়

মোঃ আমিরুল হক : গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নিজের গ্রাম রেখে দুরের একটা প্রাইমারি স্কুলে যায়। সেই সকালে তিন চার কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায় আবার শেষ বিকেলে হাটু পযর্ন্ত ধুলাবালি লাগিয়ে অনেকটা ঝিমুতে ঝিমুতে বাড়ি ফেরে। সন্তানের কষ্ট বুঝতে পারেন না এমন বাবা-মা আছেন বললে বড্ড ভূল বলা হবে। কেননা সন্তানের কষ্ট আল্লাহর পরে বাবা মা বুঝতে পারেন। কিন্তু বুঝেও বা কি লাভ। সব সময় সব কিছু বুঝেও কাজে আসে না। বুঝেও অবুঝ সেজে বসে থাকতে হয় নিরবে নিবিঘ্নে। কাছাকাছি কোথাও প্রাইমারি স্কুল নাই। আর তাইতো দায়ে পড়ে সব কিছু বুঝেও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দুরের স্কুলে পাঠাতে হতো বাবা মা’দের।

সচেতন ব্যক্তি ও শিক্ষানুরাগী শ্রী সুধির কুমার সোম তার তীক্ষ্ণ অন্তদৃষ্টি দিয়ে গ্রামের ছেলে মেয়েদের এমন কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাইতো নিজেকে থামিয়ে রাখতে না পেরে গ্রামের কিছু সচেতন ব্যক্তিদের ডেকে একটা আলোচনা করেন। গ্রামে একটা প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখেন। সুধির কুমার সোম এর এমন মহানুভব উদ্যোগে সন্তুষ্টি জ্ঞাপন পূর্বক গ্রামের কিছু শিক্ষিত যুবকগণ এবং সুধির কুমার সোমের ছেলে শ্রী স্বপন কুমার সোম একাগ্রতা ঘোষণা করেন। এগিয়ে আসেন আপনাআপনি। গ্রামের সকল মানুষ সুধীর সোমের প্রস্তাবে উৎফুল্ল হয়ে তার প্রশংসায় মত্ব হয়ে উঠেন। ব্যাপক সাড়া পড়ে সুধীর সোমের উদ্যোগে। আলোচনায় এটা নির্ধারণ হয়ে যে আসলেই গ্রামে একটা প্রাইমারি স্কুল থাকাটা খুব জরুরি। তখন প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় স্কুল নির্মাণ করতে হবে ঠিক আছে কিন্তু স্কুল নির্মাণের জন্য কিছু জায়গা প্রয়োজন। সুহৃদয়বান, সচেতন, শিক্ষানুরাগী ও শিশু প্রেমী মানুষেরা যাদের মনে শুধু সমাজ নিয়ে ভাবনা। অদূর ভবিষ্যাতে সমাজের কি হবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামান, একটা শিক্ষিত সমাজের স্বপ্ন দেখেন। প্রকৃত অর্থে সমাজের মহানুভব ব্যক্তিরা কখনও তাদের ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখেন না বা দেখতে পারেন না। তারই এক বাস্তব প্রমাণ শ্রী সুধীর কুমার সোম। স্কুল নির্মাণের জায়গার জন্য বৈঠকে মানুষ যখন হন্ন হয়ে মাথা খাটাচ্ছিলেন তখন কিছু না ভেবেই সহৃদয়বান ব্যক্তি সুধীর কুমার সোম নিজের ৩৩ শতাংশ জায়গা দিয়ে দেন।

শিক্ষার জন্য, সমাজের কল্যাণের জন্য বিশেষ করে যারা শিশুদের ভালোবাসেন, শিশুদের নিয়ে ভাবেন, শিশুদের পথচলাকে সহজ করতে কাজ করে যান তাদের কে কেন জানি মহামানব মনে হয় আমার। তাদের হৃদয়ের কোমলমতী মমতা, হৃদয়ের প্রশস্ততা মনে শান্তি বয়ে আনে। অবশেষে সুধীর সোমের দেওয়া ৩৩ শতাংশ জায়গার উপর বাঁশ খুঁটি গেড়ে নির্মাণ করা হয় একটু প্রাইমারি স্কুল।

সময়টা ছিল ১৯৮৭ সাল। রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি থানাধীন ৩নং নবাবপুর ইউনিয়নের কুড়িপাড়া পদমদী গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলো ”পদমদী চন্দনা গুচ্ছগ্রাম যোগেন্দ্র নাথ প্রাইমারি স্কুল”। সুধীর কুমার সোমের ছেলে স্বপন কুমার সোম, মোঃ আব্দুস সাত্তার মোল্লা, মোঃ আক্কাছ আলী ও মোঃ ফরিদউদ্দিন শেখ স্কুলের পাঠ দান কার্যক্রম শুরু করেন। উদ্যোক্তাদের দেয়া সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে পরিচালিত হতে থাকে স্কুলের কার্যক্রম। স্কুলের সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষই ছিলেন এক এক জন নিখাঁট স্বেচ্ছাসেবক। কেননা একটা নয় দুইটা নয় দীর্ঘ অনেকটা বছর নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরবিচ্ছিন্ন চেষ্টার ফল স্বরুপ স্কুলটিকে সরকারিকরণ করতে সরকারি স্কুলগুলোর তালিকায় আনতে সমর্থ হন।

২০১৩ সালে ৭২নং পদমদী চন্দনা গুচ্ছগ্রাম যোগেন্দ্র নাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে সরকারিকরণ ( জাতীয়করণ) করা হয়। স্কুলের সূচনা লগ্নে শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও আস্তে আস্তে সেটার পরিমাণ এসে দাড়ায় ১৪৭ জনে। নাড়ির টানেই হোক আর মাটির টানেই হোক কেন জানি নিজের অজান্তেই মাঝে মাঝে এমন এমন কিছু স্থানে গিয়ে হাজির হয়। নিজের চোখে দেখি নিজের অতীতকে। খুঁজে পাই জীবনের আসল অর্থ, ফিরে পেতে ইচ্ছে হয় জীবনের হারানো শৈশব কে। আমি নিজে পড়িনি এই স্কুলে কিন্তু যেদিন এই স্কুলটা দেখতে গিয়েছিলাম। স্কুলের মাঠে ছেলে মেয়েদের দুরুন্তপনা দেখে, আনন্দ উৎফুল্লতা দেখে কেন জানি মনে হচ্ছিল আমিও পড়েছি এই স্কুলে। কবি যথার্থই বলেছিলেন, ”বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র”।

সেদিন সকাল নয়টার দিকে গিয়ে হাজির হলাম ঐ স্কুলে। তখনও সকল ছেলে মেয়েরা এসে পৌঁছায়নি। নয়টার আগেই স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা এসে পড়লেন।পতাকা উত্তোলন করা হলো। ফাল্গুনে বাতাসে পতপত করে উড়তে শুরু করলো জাতীয় পতাকা। ঘণ্টার আওয়াজে স্কুলের সকল ছেলে মেয়েরা জড়ো হলো। সমোবেত হলো স্কুলের সামনের খোলা মাঠে। পিটি প্যারেড শেষ করে শপথ, তারপর সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া হলো। জাতীয় সংগীত শেষে যার যার শ্রেণি কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। আগে এখানে টিনের ঘর থাকলেন ২০১৮ -২০১৯ অর্থ বছরে একটি দ্বিতল বিন্ডিং ঘর নির্মাণ করলেও এখানে নেই বাউন্ডারি ওয়াল। স্কুলের সামনে দিয়ে রয়েছে পাকা সড়ক। স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ছুটোছুটি করে প্রায়শই। যেকোন মূহুর্তে দূর্ঘটনার আশংকা কাজ করে শিক্ষকদের মধ‍্যে। সম্প্রতি স্থাণীয় অভিভাবকদের নিকট থেকে কিছু টাকা নিয়ে এবং শিক্ষকদের ব‍্যাক্তিগত অর্থ দিয়ে প্লাষ্টিকের নেট আর বাঁশ দিয়ে কোনরকমে অস্থায়ী বাউন্ডারি দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জানানো হলেও তেমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এরই মধ‍্যে ২জন শিক্ষক এলপিআরে চলে গেছেন। এখানে শিক্ষক সংকটও দেখা দিয়েছে। এতেকরে পাঠদান ব‍্যাহত হচ্ছে।
২০১৩ সালে সরকারি বা জাতীয়করণ হলেও স্কুলের তেমন কোনও পরিবর্তন আসেনি। এরই মাঝে নতুন জাতীয়করণ হওয়া অনেক স্কুলেই ব‍্যাপক পরিবর্তন হলেও ৭২নং পদমদী চন্দনা গুচ্ছগ্রাম যোগেন্দ্র নাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ের দেখার মতো কোন পরিবর্তন আসেনি একটি দ্বিতল ভবন ছাড়া।বিদ‍্যালয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়কটি কর্তৃপক্ষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও লাভের হিসাবটা শুণ্যে এসে ঠেকেছে বার বার।

এবিষয়ে কথা হয় বিদ‍্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ ফরিদউদ্দিএর সাথে। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষিত বেকার যুবসমাজ এই বিদ‍্যালয়ের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে গুটিগুটি পা পা করে এই পযর্ন্ত এগিয়ে এনেছি। জাতীয়করণের পর সরকার অনেকটাই উন্নয়ন করেছেন। এখন শুধু বাউন্ডারি ওয়াল এবং একটি গেইট নির্মাণ করে দিলেই বিদ‍্যালয়টি পরিপূর্ণ রূপ পায়। আমরা শিক্ষা অধিদপ্তরের দূষ্টি আকর্শন করছি যেন দ্রুত এই দুইটির ব‍্যাবস্থা করেন।

বিদ‍্যালয়টির উন্নয়ন ও দৃশ‍্যপট ভিন্নতর বিষয়ে কথা বলেন, সোনার বাংলা সমাজ কল‍্যান ও ক্রীড়া সংসদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক এস,এম হেলাল খন্দকার এর সাথে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের এই বিদ‍্যালয়টিতে বিনা বেতনে শ্রম দিয়ে এলাকার ছেলে মেয়েদের মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। বর্তমান সরকার শিক্ষাকে গতিশীল করতেই বিগত ২০১৩ সালে এইসব বিদ‍্যালয়গুলোকে জাতীয়করনের আওতায় নিয়ে আসে। এবং বিভিন্ন উন্নয়ন করেন বিদ‍্যাপিঠের। অনেকস্থানেই অনেক বিদ‍্যালয় দেখার মতো করে গড়ে তুলেছেন। আমরাও সকলে মিলে আশা করছি এই বিদ‍্যালয়টিতে কিছু করে দেখার মতো করে তোলার জন‍্য। এরজন‍্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সহযোগিতা প্রয়োজন।

সর্বশেষ পোষ্ট

এই ধরনের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here