রাজবাড়ী’র সুবর্ণা রানী দাস। দুটি চোখই তার অন্ধ। বহুদিন যাবত দেখছেন না বর্ণিল এই পৃথিবীকে। রাত আর দিনের পার্থক্যই কেবল করতে পারেন তিনি। তাই বলে তো থেমে থাকে না জীবন। অন্ধ দুচোখ দিয়েই দেখেন আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। তাইতো অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে দৃষ্টিহীনতা আজ পর্যন্ত তার কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে, শ্রুতি লেখকের সাহায্যে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে জায়গা করে নিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বাংলা বিভাগে।
সুবর্ণার সফলতার পিছনের গল্পটি শুনা হয় তার নিজের মুখেই। তিনি বলেন, আমি জীবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেই এ পর্যন্ত এসেছি। কারণ আমার যখন দুইমাস বয়স তখন আমার বাবা সুবাস দাস মারা যায়। তারপর থেকে আমার মা কণিকা রানী দাস দুঃখ, কষ্ট আর দৈন্যতার সঙ্গে লড়াই করে মানুষের বাসায় কাজ করে, কাঁথা সেলাই এবং হাঁস-মুরগী পালনসহ বিভিন্নভাবে আমার পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছেন।
সুবর্ণা বলেন, আমার বাড়ি ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ী জেলায়। বাড়িতে আমি, মা এবং আমার নানু থাকতেন। বাড়ি থেকে আমার স্কুল ছিল অনেক দূরে। প্রায় এক থেকে দেড়শ টাকা ভাড়া লাগত যাতায়াতের জন্য।
কিন্তু আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল যে আমি ভবিষ্যতে অনেক বড় কিছু করব। তাই যেটুকু গাড়িতে না গেলেই নয় সেটুকু ব্যতিত বাকি পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে গেছি। আমার মা অনেক কষ্ট করে রোদে পুরে, বৃষ্টিতে ভিজে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন।
ভবিষ্যতে ম্যাজিস্ট্রেট হতে চায় সুবর্ণা। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আমি একজন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা একজন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষিকা হতে চাই। আর আমার এ স্বপ্ন পূরণে রাবি প্রশাসন যদি আমার মতো সব প্রতিবন্ধীদের পড়াশোনার সব ফি মৌকুফ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য একাডেমিক ভবনগুলোতে লিফটের ব্যবস্থা করেন তাহলে আমাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। আর আমি গান, অভিনয় এবং আবৃতি পারি। ছাত্রাবস্থায় এসবের মাধ্যমেও অর্থ উপার্জন করে নিজে সাবলম্বী হতে চাই।
সুবর্ণা আরও বলেন, অনার্স লেভেলে আমাদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে কোনো বই নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি এ ব্যাপারে সরকারের কাছে আমাদের হয়ে ব্রেইল পদ্ধতিতে বই তৈরির দাবি জানায় তাহলে আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা উপকৃত হবো। পাশাপাশি অর্থাভাবে মেসে অবস্থান করা আমার পক্ষে কষ্টকর, এক্ষেত্রে দ্রুত হল পেলে উপকৃত হতাম।
সুন্দর এই পৃথিবীকে আবারও দুচোখ ভরে দেখতে চায় সুবর্ণা। সুবর্ণা বলেন, আমি জন্মান্ধ ছিলাম না। তবে আমার দুচোখে সমস্যা ছিলো। আমি যখন কথা বলতেই শিখিনি তখন রাজধানীর ইসলামীয়া হাসপাতালে আমার বামচোখে অপারেশন করা হয়। তখন ডাক্তার বলেছিল এটি ভালো হয়ে যাবে কিন্তু ভালো না হয়ে সেটি আরও খারাপ হয়ে গেছে। পরবর্তীতে যখন একটু বড় হলাম তখন ডানচোখেও অপারেশনের জন্য তারা প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু আমি এ পথ থেকে সরে দাঁড়াই।
সুবর্ণা জানায়, বর্তমানে তার ডানচোখটিও প্রায় নষ্ট। দিন রাতের পার্থক্য নিরূপন আর সামনে কোনোকিছু থাকলে সেটি অনুভব করতে পারেন তিনি। তবে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে পৃথিবীকে দুচোখ ভরে দেখতে পাবেন বলে আশাবাদী সুবর্ণা।
kkn