নেহাল আহমেদ: বাংলাদেশে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অধিকাংশ গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি বা লোকঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। শহরে বসবাস করা নতুন প্রজন্ম অধিকাংশই গ্রামীণ যাত্রাপালা, পুতুলনাচ দেখেনি। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল ইত্যাদি মাটির সাথে সম্পর্কিত সংগীত শোনেনি। যদিওবা শুনেছে, তা শহরের শিল্পীদের মুখে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে প্রয়াস থাকা উচিত, তা একেবারেই ক্ষীণ। একেবারে নিভু নিভু প্রদীপের মতো। কোনো মতে জ্বলছে। যা হচ্ছে এর অনেকটাই দায়সারাভাবে। যা কখনোই সাংস্কৃতিক কর্মিদের কাম্য নয়।
বার বার সংস্কৃতিকর্মীদের চাওয়া, দেশের মোট বাজেটের ১ শতাংশ হোক সংস্কৃতির। সেই চাওয়া আজও পূরণ হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে সংস্কৃতির বাজেট যেন কোনো কোনো বছরে আগের বছরের চেয়েও কমে যায়। বাজেটে সংস্কৃতি বরাবরই উপেক্ষিত হয় বলে মনে করছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিরা।তারা বিভিন্ন বিবৃতি ও দিয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগেরই বক্তব্য, সংস্কৃতির সবকিছুকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও তা শুধু মুখে মুখেই থেকে যায়।বাস্তবায়ন হয়না কখনোই।
বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সংস্কৃতির জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হোক। সাংস্কৃতির জন্য যে বাজেট করা হয় তা প্রত্যাশার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল, সাংস্কৃতির জন্য ছিলো এর আগে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের ০.০৯৮ শতাংশ। সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে অপ্রতুল বাজেট করা হয়ে ছিলো যা আসলে সাংস্কৃতি কর্মিদের সাথে এক ধরনের উপহাসই বলা যায়।
বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর সংস্কৃতি নিয়ে সব সময় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে। তারা মনে করে, সংস্কৃতি মানেই শুধু গান-বাজনা, নাচ, এই আরকি। এসব হলেও হয়, না হলেও হয়। এ ছাড়া প্রতিটি দলের অভ্যন্তরে ঘাপটি মারা একটা মৌলবাদী শক্তি রয়েছে, তারা খুবই শক্তিশালী। তারা মনে করে, সংস্কৃতিকে এত বিকশিত হতে দেওয়ার কী আছে। এরা কিন্তু বুঝতেই পারছে না, দেশে একটা প্রতিবিপ্লব হয়ে গেছে,মৌলবাদী গোষ্টি চারা দিয়ে উঠেছে।আস্তে আস্তে বিষ বৃক্ষে পরিনত হচ্ছে। এই প্রতিবিপ্লবকে ঠেকানোর জন্য জোড়ালো সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার।
বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস, সাহিত্য এবং ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেনা বলেই দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ দেশ প্রেমে আকৃষ্ট না হয়ে বিভিন্ন উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে।
একমাত্র বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চাই পারে, সেই উগ্রবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে। মৌলবাদী নামক বিষ বৃক্ষ উপড়ে ফেলকে।এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে না বলেই, আমাদের যথাযথ সাংস্কৃতিক চর্চা হচ্ছে না। যতটা হচ্ছে ততটা, নামকাওয়াস্তে দায়সারাভাবে। বিষয়টি যেমন কাম্য নয়, তেমনই দুঃখজনক। সংস্কৃতি পরিচালনার জন্য সঠিক মানুষ এবং যোগ্য মানুষ বেছে নেয়া দরকার।সমাজের মত সাংস্কুতিক অঙ্গনেও রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। আর এর বেশিরভাগই ঘটছে ধান্ধাবাজদের হাত ধরে। দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। সংস্কৃতির জন্য এটা একটি লজ্জাজনক ব্যাপার।
একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়ানা দরকার। সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য, চারুকলা নাটকের শিল্প সাহিত্যের জন্য পর্যাপ্ত লোক নিয়োগ করা এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার।দরকার রুগ্ন সাংস্কৃকিত সংগঠন গুলোকে বাচিঁয়ে তোলা। স্থানীয় ক্লাবগুলোকে সাংস্কৃতিক সংগঠনে পরিণত করার উদ্যোগ নিতে হবে, লাইব্রেরীর সংখ্যা বাড়াতে হবে খেলার মাঠ তৈরি করতে হবে এর জন্য পর্যাপ্ত বাজেট দিতে হবে। শিশু সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, বই পড়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ করা দরকার সংস্কৃতিক কর্মিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। নয়তো মাদক, অপসংস্কৃতি কিশোর গ্যাং অ্যান্ড্রয়েড ফোনের গ্রাসে অসুস্থ প্রজন্ম গড়ে উঠবে।দেখা দেবে রুচির দুর্ভিক্ষ।
নেহাল আহমেদ
সাংবাদিক ও কবি।