Monday, April 29, 2024

বিলুপ্ত প্রায় গ্রামবাংলার হ‍্যাজাক লাইট

মোঃআমিনুল হকঃ  আগের দিনে গ্রাম বাংলার প্রতিটি এলাকার মোড়ল প্রকৃতির মানুষদের বাড়ীতে দু’ একটি হ‍্যাজাক লাইট পাওয়া যেতো। বাড়ীতে কোনো বড়, ছোট অনুষ্ঠান হলেই সেইদিনে সকাল থেকে শুরু হতো এই বস্তুটি ঝাড়ামোছার কাজ। এরপর সন্ধ‍্যায় নেওয়া হতো জ্বালানোর প্রস্তুতি। যে কোনো ব‍্যাক্তি এই বিশেষ লাইটটি জ্বালাতে পারতো না। সেই দিন জ্বালানোর মতো বিশেষ ব‍্যাক্তিকে সমাদরে ডেকে আনা হতো অনুষ্ঠান বাড়ীতে। সেই দিন তার চাল চলন থাকতো আলাদা রকমের।
বাড়ীর কচি কাচারা হ‍্যাজাক প্রজ্জ্বলনকে কেন্দ্র করে গোল হয়ে বসতো উঠোনে। এরপর তিনি হ‍্যাজাকে তেল আছে কিনা ভালোভাবে পরীক্ষা করে শুরু করতেন পাম্প করা। এরপর একটা পিন দিয়ে বিশেষ স্থানে খোঁচাখুঁচি করা হতো একটি বিশেষ পয়েন্টে। তারপর হ‍্যাজাকের একটা নব ঘুরিয়ে কিছু জ্বলন্ত কাগজ তার সংস্পর্শে আসতেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠতো। আর তখন শুরু হতো আচ্ছা করে পাম্প দেওয়া। তারপর হ‍্যাজাক লাইটের মাঝখানের ম‍্যান্টল থেকে বেরোতে থাকতো বেশ উজ্জ্বল আলো। সেই সাথে বুকে কাঁপন ধরানোর মতো হিসসসসস আওয়াজ হতো। আবার মাঝেমধ‍্যে হ‍্যাজাকের উপর দিয়ে হুস করে আগুন জ্বলে উঠতো। আবার কখনো গোটাটাই নিভে যেতো। সফলভাবে হ‍্যাজাক লাইট জ্বালানোর পর ঐব‍্যাক্তির মুখে ফুটে উঠত পরিতৃপ্তির হাঁসি। আর হ‍্যাজাকের সেই উজ্জ্বল জাদুর আলোয় কচিকাচারা চলে যেত এক আনন্দের জগতে। গ্রাম বাংলা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন দিনের উজ্জ্বল আলো ছড়ানো হ‍্যাজাক লাইট নামের এই বস্তুটি। বিয়ে – শাদি, সুন্নত্তে খাৎনা, পূজা – পার্বন, যাত্রাপালা এমনকি ধর্ম সভাতেও ভাড়া করে আনা হতো হ‍্যাজাক লাইট। হ‍্যাজাক লাইট দেখতে অনেকটাই হ‍্যারিকেনের মতো, তবে আকাড়ে বেশ খানিকটা বড়। আর প্রযুক্তিও ভিন্ন ধরণের। জ্বলে পাম্প করে জালানো সাদা কেরোসিনের কুকারের মতো একই প্রযুক্তিতে।
চুলার বার্নারের পরিবর্তে এতে আছে একটি ঝুলন্ত সলতে। যেটা দেখতে প্রায় ১০০ ওয়ার্টের সাদা ট‍্যাংস্টেল বাল্বের মতো। এটি আ‍্যজবেস্টরে তৈরী। এটি পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যায় না। পাম্প করা তেল একটি নলের মাধ‍্যমে জোড়ে গিয়ে স্প্রে করে ভিজিয়ে দেয় সলতেটাকে। এটা জ্বলতে থাকে যতক্ষণ চেম্বারে তেল আর হাওয়ার চাপ থাকে ততক্ষণ। তেলের চেম্বেরের চারপাশে থাকে চারটি নফ বা বোতম। একটি হাওয়ার চাবি, একটি আ‍্যকশন রড, একটি পাম্পার আর একটি অটো লাইটার বা ম‍্যাচ। আ‍্যকশন রডের কাজ হলো তেল বের হওয়ার মুখটা পরিস্কার রাখা। হাওয়ার চাবি দিয়ে পাম্পারের হাওয়া প্রয়োজন মতো কমানো বা বাড়ানো হয়। আর একবার হাওয়া দিলে হ‍্যাজাকটি জ্বলতে থাকে বেশ কয়েক ঘন্টা। দেড় লিটার তেলে চলে সারা রাত। বর্ষার শুরুতে এবং শীতের শুরুতে যখন নদী – নালায় পানি কমতে শুরু করে তখন হ‍্যাজাক জ্বালিয়ে মাছ শিকার করে বিল হাওড় এলাকার অনেকেই। তবে এটা চলে বছরের মাত্র দু’ তিন মাস। বাতি এক প্রকার সরঞ্জাম। বাতির ব‍্যাবহার অতিব প্রাচীন। সাধারণত বাতি বলতে বোঝায় কুপি, টর্চ লাইট, হ‍্যারিকেন ও হ‍্যাজাক লাইট। বাতি হলো সেই সরঞ্জাম, যা অন্ধকার দুর করতে ব‍্যবহার করা হয়।
প্রাচীনকালে আগুনের ব‍্যবহারের মাধ‍্যমে বাতির প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে অধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে সবখানেই। ফিলামিড বাতির পরিবর্তে এলইডি বাতির ব‍্যবহার নতুন নয়। তবে এলইডির সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তির বাতিও স্মার্ট। বিভিন্ন এলাকার বাজারগুলো ঘুরে জানানো হচ্ছে বাসা – বাড়ী, অফিস – আদালত, মিল, কল – কারখানায় ব‍্যবহৃত নানান ধরণের বাতির খোঁজ। আধুনিক প্রযুক্তির আদলে দেশে গজিয়ে উঠেছে জানা অজানা, নামি, বেনামি বহু এলইডি বাল্ব কারখানা। বাজারে লোভনিয় অফার দিয়ে বিক্রি করে হারিয়েও গেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। আধুনিক প্রযুক্তিতে আধুনিক প্রতারনাও বেড়েছে।
হ‍্যাজাক লাইট মেরামতকারী মোঃ আঈবর হোসেন, মোঃ আবুল হোসেন বিশ্বাস, শ্রীকান্ত সরকার এর সাথে কথা হলে তারা জানান, যখন কোন মাইকে, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে শাহ্ আব্দুল করিমের গান “গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাঁটাইতাম”। তখন মনে পড়ে আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগে যখন হ‍্যাজাক লাইটের ব‍্যবহার যথেষ্ট ছিল। তখন এই লাইট মেরামত করে দিনে আয় ভালো হতো। দিনে ৫/৬টি হ‍্যাজাক লাইট মেরামত করে আয় হতো ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে হ‍্যাজাক লাইট নেই বললেই চলে। তাই এখন এই পেশাটাকে পরিবর্তন করে বাই সাইকেল, ভ‍্যান, রিক্সা মেরামতের কাজ করি।

সর্বশেষ পোষ্ট

এই ধরনের আরো সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here